জঙ্গি উৎপাদনকেন্দ্র খারিজি মাদ্রাসাগুলি নিষিদ্ধ করতে হবে
প্রসঙ্গত বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে জঙ্গি আয়েশা হলো পশ্চিমবঙ্গর একজন হিন্দু বালা। ওর পিতৃদত্ত নাম ছিলো প্রজ্ঞা দেবনাথ। জেএমবি-র সংস্পর্শে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তার নাম রাখা হয় আয়েশা জন্নত মোহনা। জেএমবিতে প্রজ্ঞার আর একট নাম রয়েছে - জান্নাতুত তাসনিম।
সংক্ষেপে জেএমবি-র পরিচয় দেওয়া যাক। এর পুরো নাম হলো জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালে এর জন্ম বাংলাদেশে এবং এটি ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়দা কতৃক অনুমোদিত। পরে বিশ্বত্রাস আইএস-এর সঙ্গেও এরা সম্পৃক্ত হয়। ভারতের জঙ্গি সংগঠন ইণ্ডিয়ান মুজাহিদ সহ আরও কিছু সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সাথে তাদের গাটছড়া রয়েছে। আর্থিক সহায়তা সহ সব রকমের মদত পায় এরা পাকিস্তান সরকার ও আইএসআই-এর কাছ থেকে। এদের মূল কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের মাটিতে হলেও সাংগঠনিক জাল (নেটওয়ার্ক) ও কর্মকাণ্ড দেশের বাইরেও বিস্তৃত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এরা খুবই সক্রিয়। পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি বানিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা দখল করা ওদের মূল লক্ষ্য। কিন্রু সেখানেই থেমে থাকতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গ দখল করে বৃহত্তর বাঙ্গালিস্তান তৈরি করাও এদের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তাতে হতোদ্যম না হয়ে এক দিনে গোটা দেশে ১৭ট জেলায় ৩৭৬টি জায়গায় ৫০০টি বোমা ফাটিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানায়। তারা নিজেদের আল্লাহ ও ইসলামের সৈনিক বলে দাবি করে এবং বাংলাদেশে ইসলামি রাষ্ট্র গড়া থেকে কোনো শক্তি তাদের নিরস্ত করতে পারবে না ঘোষণা দেয়। আরও ঘোষণা দেয় যে আল্লাহর সৃষ্ট ভূখণ্ডে আল্লাহর শাসন ছাড়া মানুষের তৈরি করা সংবিধানের শাসন চলতে পারে না।
বর্তমানের জঙ্গি জেএমবি সংগঠনটি কিন্তু মূল জেএমবি নয়। এরা নব্য জেএমবি তথা নব্য জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ। সেখ আব্দুর রহমান এবং সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই সহ জেএমবি-র ছ’জন শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের র্যাবের হাতে ধরা পড়ে ২০০৫ সালে। দু’জন সহকারি বিচারক সহ কয়েকজন সরকারি আধিকারিককে খুনের অভিযোগে ২০০৭ সালে তাদের ফাঁসী হয়। তারপর সংগঠনটির ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। ফাঁসীতে নেতাদের মৃত্যু হলে তো আর মন্ত্রের (আদর্শের) মৃত্যু হয় না। তাই জেএমবি-র ছত্রভঙ্গ সদস্যরা পরে সংগঠনটির পুনর্জন্ম দেয় যেটা নব্য জেএমবি বলে পরিচিতি লাভ করে। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের হোতা জেএমবি হলো সেই নব্য জেএমবি এবং ঢাকায় ধরা পড়া মহিলা জঙ্গি আয়েশা জন্নত মোহনা সেই নব্য জেএমবি-র একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
শীর্ষ নেতাদের হারিয়ে সাময়িকভাবে জেএমবি দুর্বল হয়ে গেলেও বাকি জঙ্গিরা সংগঠনটিকে পুনর্গঠন করে নব্য জেএমবি নামে রত্মপ্রকাশ করে ২০১৪ সালে। আমরা সেটা টের পাই ২০১৬ সালে খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ কাণ্ডে। পশ্চিমবঙ্গরেও অনেক সদস্য রয়েছে জেএমবিতে সেটাও জানা যায় ওই বিস্ফোরণ কাণ্ডে এন.আই.এ (National Investigation Agency)-এর তদন্ত রিপোর্ট থেকে। নব্য জেএমবিতে যে নারী জঙ্গিদের জন্যে আলাদা শাখা রয়েছে সে তথ্যও ছিলো এন.আই.এ)-এর রিপোর্টে। মুসলিম জঙ্গি সংগঠনে নারী সদস্য থাকাটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ইসলামের নবীর আমল থেকেই এটা হয়ে আসছে। আইএস (Islamic State)-এর যখন রমরমা অবস্থা তখন দেখেছি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীরাও দলে দলে ইরাকে গিয়ে আইএস-এর পতাকা স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিয়েছে। উচ্চশিক্ষিত মুসলিম নারী-পুরুষদের একাংশের মধ্যে এই প্রবণতাটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা এ জম্যেই ঘটে যেহেতু ইসলাম ধর্মে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জন্যেই জিহাদ ফরজ (অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য)। ইসলাম এও বলেছে যে জিহাদীদিরা বেহেস্তে (স্বর্গে) যাবে আর জিহাদে অংশ না নিয়েই যারা মারা যাবে তাদের দোজখের (নরকের) আগুনে অনন্তকাল পুড়তে হবে। তাই যুগে যুগে মুসলিম জঙ্গি সংগঠনে নারীদের উপস্থিতি দেখা যায়। স্বভাবতই মূল সংগঠনের অধীনে তাদের জন্যে পৃথক মহিলা শাখা থাকাটাও খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
নব্য জেএমবি কিন্তু বিষ্মিত করেছে অন্য দু’টি কারণে। তা হলো, প্রথমতঃ, ২০০৭ সালে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসী হবার পর মাত্র সাত বছরের মধ্যেই বিধ্বস্ত ও ছন্নছাড়া সদস্যরা জেএমবিকে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছে। এবং সক্ষম হয়েছে বিশ্বকে চমকে দেবার মতন একটি ঘটনা ঘটাতে। সেটা হলো, হিন্দু পরিবার থেকে একজন তরুণিকে সংগঠনের সদস্য করে তাকে সংগঠনের একজন আদর্শ ও যোগ্য নেত্রী হিসাবে গড়ে তুলতে। একজন বিধর্মী মেয়ের মস্তিষ্ক ধোলাই করে সংগঠনে নিয়ে আসা এবং তাকে পুরোদস্তুর জিহাদি আদর্শে গড়ে তুলে আপাদমস্তক জঙ্গি করে তোলার ঘটনা নিঃসন্দেহে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতন ঘটনা। এটা আমাদেরকে বিষ্ময়ে হতবাক ও উদ্বিগ্ন করে তোলার মতন ঘটনাও বটে। চাপ সৃষ্টি না করে কিংবা ভয় না দেখিয়ে কোনো কাফের কন্যাকে কট্টর ইসলামি আদর্শে পথে সফলভাবে হেদায়েত (convince) করতে পারার ঘটনা সমগ্র ইসলামের ইতিহাসে সম্পূর্ণ বেনজির ঘটনা কিনা বলতে পারবো না, তবে এটা নিশ্চয়ই একটা বিরলতম ঘটনা বটে।
মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলি সদশ্য সংগ্রহ করার জন্যে দরিদ্র হিন্দুদেরকেও নিশানা করেছে
হিন্দু পরিবার থেকে প্রজ্ঞা দেবনাথকে সংগঠনের মধ্যে সাফল্যের সাথে তুলে নিয়ে এসে তাকে একজন জঙ্গিনেত্রী হিসেবে গড়ে তোলার নব্য জেএমবি-র চরম বিষ্ময়কর সাফল্য আমাদের দৃষ্টির সামনে একটা নতুন দিক খুলে দিয়েছে। আমরা এতদিন পর্যন্ত দেখে এসেছি ও জেনে এসেছি যে মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলো মূলত জঙ্গি সদস্য সংগ্রহ করে খারিজি মাদ্রাসা থেকে এবং তাদের নিশানা থাকে প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের দরিদ্র পরিবারগুলির প্রতি। গ্রামে গঞ্জে গড়ে ওঠা খারিজি মাদ্রাসাগুলিই তো জঙ্গি সরবরাহ করে জঙ্গি সংগঠনগুলিকে। তাই খারিজি মাদ্রাসাগুলিকে শুধু মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল হিসেবে দেখলে মস্তবড়ো ভুল হবে। আসলে এই মাদ্রাসাগুলিই হচ্ছে জঙ্গি সরবরাহকারী প্রধান সংস্থা যাকে ইংরাজী ভাষায় ফিডিং সেন্টার বলা হয়। এই মাদ্রাসাগুলিকে জঙ্গি সংগঠনগুলির ধমনিও (সাপ্লাই লাইন) বলা যায়, কারণ সেখান থেকেই তো ওদের ফুসফুসে (সংগঠনে) নিয়মিত রক্ত (জঙ্গি) সবরাহ হয়। এটা যে শুধু অনুমান কিংবা তত্ত্বকথা নয় সেটা খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে এন.এই.এ (NIA) হাতেনাতে ধরে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে। এ কথা অবশ্য সম্পূর্ণ অস্বীকার করে গণতন্ত্রের আলখাল্লা (মুখোশ) পড়া মুসলিম ধর্মগুরু ও বুদ্ধিজীবীরা। আবার জেএমবি ও প্রজ্ঞার কথায় ফিরে আসি। প্রজ্ঞার মুসলিম জঙ্গি হবার ঘটনা আমাদের সামনে এতদিনের যে অজানা দিকটার উন্মোচন করলো তা হলো, জঙ্গি সংগঠনগুলোর নিশানা শুধু আর মুসলিম সমাজের দরিদ্র পরিবারগুলোর প্রতিই আটকে নেই, তারা বিধর্মীদের হতদরিদ্র পরিবারগুলিকেও নিশানা করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে প্রজ্ঞা দেবনাথের জন্ম ও মানুষ হওয়া সে রকমই একটি অতি দরিদ্র পরিবারেই। প্রজ্ঞার বাবা দিনমজুরি করে এবং মা বাড়িতে কাপড় সেলাই করে কোনো রকমে দিন গুজরান করেন।
বাংলাদেশ পুলিশের কাছ থেকে আর একটা বিষ্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। তা হলো, কলেজে পড়তে পড়তে নয়, প্রজ্ঞা জঙ্গি আদর্শে দীক্ষিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে স্কুলে ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০০৯ সালে। আর সে বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে জঙ্গি শিবিরে চলে যায় ২০১৬ সালে। সেই সাত/আট বছর (২০০৯ থেকে ২০১৬) সে তার মুসলিম জঙ্গি পরিচয় গোপন রেখে সবার চোখে ধূলো দিয়ে হিন্দু হয়েই তার পরিবারের সঙ্গে থেকেছে এবং একজন হিন্দু মেয়ের মতনই সমস্ত রকম ধর্মাচারণ করেছে। জেএমবি-র সদস্য হওয়ার পর আর পাঁচজন নারী জঙ্গির মতন সেও একজন প্রবাসী বাংলাদেশি জঙ্গিকে বিয়ে করে। তার স্বামী ওমানে থাকে বিধায় তাদের বিয়ে হয় ফোনের মাধ্যমে। জেএমবির শিবিরে পাকাপাকিভাবে চলে যাবার পরও ফোনে সে তার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। ফোনেই তার মাকে সে একদিন জানায় যে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং একজন মুসলিম যুবককে বিয়েও করেছে, এশিয়া মহাদেশে কোনো পরিবার ও সমাজই কারও ধর্মান্তরিত হবার ঘটনা মেনে নেয় না। এমন ঘটনা চরম অন্যায় ও লজ্জাজনক ঘটনা বলে মনে করা হয়। তাই তার পরিবার তাদের লজ্জার কথা কখনো ফাঁস করে নি। প্রজ্ঞা ওরফে আয়েশা জন্নত মোহনা ওরফে জান্নাতুত তাসমিন বাংলাদেশ পুলিশের হাতে ধরা না পড়লে প্রজ্ঞার জঙ্গি হবার বিরলতম ঘটনা এবং নব্য জেএমবি যে তাদের সংগঠনের জাল বিস্তার করার কাজ পুনরায় পূর্ণ উদ্যমে শুরু করেছে সে খবর অজানাই থেকে যেতো। ২০১৬ থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হবার আগে পর্যন্ত প্রজ্ঞা ওরফে আয়েশা বাংলাদেশ ও ভারতে যাতায়াত করে জঙ্গি ও অর্থ সংগ্রহ করার কাজ করেছে। অনলাইনের মাধ্যমেও সে জঙ্গি সংগ্রহের কাজ করতো। অনলাইনের মাধ্যমেই সেও জেএমবির সংস্পর্শে এসে ইসলামে দীক্ষা নিয়েছে। প্রজ্ঞা ওরফে আয়েশা খারিজি মাদ্রাসাগুলিতে নব্য জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেবার কাজের দায়িত্বও পালন করতো। জেএমবি-র মহিলা শাখার প্রধান আসমানি খাতুন পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর থেকে মহিলা শাখার প্রধানের দায়িত্ব এই প্রজ্ঞাই যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে পালন করেছে।
বাংলাদেশ পুলিশ আয়েশাকে (প্রজ্ঞাকে) ধরতে পারলো, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ পারলো না কেন?
উপরের প্রশ্নটি নিঃসংশয়ে বৈধ প্রশ্ন। এক কথায় এর জবাব হলো – বাংলাদেশ সরকার চেয়েছে তাই পেরেছে আর পধচিমবঙ্গ সরকার চায় নি তাই পারে নি। বাংলাদেশ সরকার যে আন্তরিকভাবেই মুসলিম জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ করতে চায় তার অজস্র দৃষ্টান্ত চোখের সামনে রয়েছে। অবশ্য যে দেশে যুক্তিবাদীদের নিরাপত্তা নেই এবং তাদের বেছে বেছে অবাধে হত্যা করা হয় সেই দেশই আবার মুসলিম জঙ্গিদের ঘাঁটিগুলি একটা করে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, এটা অবাক করার মতনই ঘটনা। এটা কীভাবে সম্ভব তা আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। এখানে শুধু একটু সংকেত বা ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে। মুসলিম মৌলবাদীরা প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত যদিও বাস্তবে তারা বহু শাখা-উপশাখায় বিভক্ত। প্রধান দু’টি ভাগের এক ভাগ জিহাদ ও ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনে বিশ্বাস করে, আর এক দল অজঙ্গি যারা কেবল মুসলিম সমাজের শরিয়তিকরণ চায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় ভাগকে তাঁর পক্ষে টানতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে জঙ্গি মৌলবাদীরা ক্রমশ শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন হাসিনা এবং জঙ্গিদের দমন সহ তাদের ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু অজিঙ্গি মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে টানার যেমন ইতিবাচক একটা দিক (জঙ্গি দমনে সাফল্য) রয়েছে তেমনি তার একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে। তা হলো, অজঙ্গি মৌলবাদীদের সঙ্গে আপোষ করতে হয়েছে এবং তার জন্যে তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এতে তাঁর হয়তো আশু ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ক্ষতি হয় নি, কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কারণ, হাসিনাকে মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে বন্ধক দিতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গ এখানেই থাক, কারণ এটা লেখার বিষয় নয়। ফিরে আসি আমাদের ও রাজ্যের প্রশ্নে। আমাদের দেশে ও রাজ্যে জঙ্গি মৌলবাদী ও অজঙ্গি মৌলবাদীদের পারষ্পরিক চমৎকার বোঝাপাড়া রয়েছে। ভয়ংকর কোনো জঙ্গি কার্যকলাপ যখন সামনে চলে আসে এবং প্রশাসন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করে তখন জঙ্গিদের ত্রাতার ভূমিকায় আসরে অবতীর্ণ হয় অজঙ্গি মৌলবাদীরা। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ধুয়া তুলে সরকার ও শাসকদলকে ভোটে হারিয়ে দেবার ভয় দেখায়। সরকার তখন সুর সুর করে লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকে যায় এবং পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। যদিও মুসলিম মৌলবাদীদের কথায় মুসলিমরা দলবেঁধে ভোট দেয় না, তবুও পাছে মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হয় এই ভয়ে সরকার মুসলিম জঙ্গি কার্যকলাপগুলি দেখেও না দেখার ভাণ করে থাকে। বাম সরকারও এ রকম অন্যায় আপোষও অনেক ক্ষেত্রে করেছে।আর মমতা ব্যানার্জীর সরকারের তো এটাই নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রতিদানও ষোলো আনায় বিশ আনা পায় তৃণমূল কংগ্রেস। প্রত্যেকটা ভোটে মুসলিম মৌলবাদীরা ঝাঁপিয়ে ভোট করে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে। এমনকি বাংলাদেশের মৌলবাদীরাও নির্বাচনের সময় শাসক দলের হয়ে কাজ করে – এ তথ্য দিয়েছিলো সিবিআই সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করার সময়। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে এই সরকার জেএমবি জঙ্গিদের এবং তাদের চিহ্নিত প্রধান আশ্রয়স্থল খারিজি মাদ্রাসাগুলিকে আড়াল করতে কীভাবে নগ্ন প্রয়াস করেছিলো সেটাতো আমাদের সবার জানা। রাজ্য সরকারের এই আত্মঘাতী বিপজ্জনক আপোষকামী নীতির জন্যেই হিন্দু পরিবারের প্রজ্ঞা দেবনাথরা কার্যত বিনা বাধায় মুসলিম জঙ্গি হয়ে উঠতে পারে এবং জঙ্গি আয়েশারাও অবাধে তাদের জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পারে। জঙ্গি আয়েশারা বাংলাদেশে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আর এ রাজ্যে ধরা পড়ে না।
বদর যুদ্ধ (মুসলমান ও মক্কার কোরেশদের মধ্যে যুদ্ধ) ছিল প্রকৃত পক্ষে একটি অসম যুদ্ধ। কারণ প্রথম পক্ষে ছিলো মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য, আর অপর পক্ষে ছিলো একহাজার। তবুও আশ্চর্যজনকভাবে প্রথম পক্ষই জিতে গিয়েছিলো। মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে এটা সম্ভব হয়েছিলো কারণ আল্লাহ মুসলিমদের পক্ষে হাজার হাজার ফেরেশতা পাঠিয়েছিলো যুদ্ধ করার জন্যে। সে রকম জেএমবিও বিশ্বাস করে যে একদিন তারাও বাংলাদেশে ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন কতে পারবে এবং পারবে পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে বৃহৎ বাঙ্গালিস্তান গড়ে তুলতে পারবে। বিশ্বাস করে কারণ তারা মনে করে আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছে। কোনোদিনই ওদের এই অবাস্তব স্বপ্ন পূরণ হবে না ঠিকই, কিন্তু মানুষের জীবনহানি ও ধন-সম্পদ ধ্বংস করার এবং মানবজাতির মধ্যে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে দেবার মতন যথেষ্ট ক্ষমতা ওদের আছে তাতো অনস্বীকার্য। তাই তাদের দিক থেকে কোনো দায়িত্বশীল সরকারই চোখ ঘুরিয়ে রাখতে পারে না। প্রত্যেকটি সরকারেরই প্রধান কর্তব্য হলো দেশ ও নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করাকে দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের উপরে স্থাপন করা। সমগ্র মানবজাতি ও মানবসভ্যতার স্বার্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমস্ত সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো জঙ্গি সংগঠন ও জঙ্গি কার্যকলাপ নির্মূল করা একান্ত আবশ্যক। আর তা করতে হলে সেই সরকারকে যেমন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার মনোভাব নিয়ে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ করতে হবে, তেমনি তারই পাশাপাশি একই সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনগুলির সাপ্লাই লাইনটাকে সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে অর্থাৎ জঙ্গি উৎপাদনকারী খারিজি মাদ্রাসাগুলিকেও চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে কোনোদিনই জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ করা যাবে না।
No comments