কী ঘটেছিল যুদ্ধ ফেরত ইয়াজিদি শিশুদের ভাগ্যে?
![]() |
Thikran Kamiran, now 19, was deemed too young to be executed with the men of his village. |
আইসিস যখন ইয়াজিদি বালকদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং জোরপূর্বক যুদ্ধে নিয়োজিত করে তখন তারা নিতান্ত শিশু। কি ঘটছে এখন আইসিসের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পরে?
টাইম ম্যাগাজিনের সৌজন্যে সরেজমিনে সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদনটি লিখেছেন কিম্বার্লি ডোজিয়ার এবং ফটোগ্রাফি করেছেন নিউশা তাভাকোলিয়ান। প্রতিবেদনটি টাইম ম্যাগাজিন এবং পুলিৎজার সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত।
ইরাকের উত্তরাঞ্চলের ছোট্ট ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ে বেড়ে ওঠা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৯ বছরের বালককে অপহরণ করে নিয়ে যায় আইসিস জঙ্গি-দল এবং তার বাবা-ভাইকে তার চোখের সামনে হত্যা করে। বন্দী অবস্থায় আইসিস তাকে শিশু যোদ্ধায় পরিণত করে। সে নিজের চোখে দেখেছে বর্ণনার অযোগ্য সহিংসতা, দেখেছে তার বন্ধুদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন। শিক্ষক নামের যারা তাদেরকে আইসিস তরিকার ইসলামের উগ্রপন্থার শিক্ষা দিতো তারা বন্দী শিশুদেরকে নির্দয়-ভাবে পেটাত।
তিন বছর পর আইসিসকে ১০,০০০ ডলার মুক্তিপণ দিয়ে তার মা তাকে যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনে। একরকম নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের পরিবারে ফিরে আসে, যে পরিবারকে সে প্রায় মনেই করতে পারে না। সে মাঝেমাঝেই পালিয়ে তাদের কাছেই ফিরে যেতে চায় যারা তাকে অপহরণ করেছিল। সে তার আপন বোনকে ছুরি হাতে খুনের হুমকি দেয়, তাদেরকে বিধর্মী কাফের বলে অভিহিত করে নিজের মাকে পর্যন্ত আঘাত করতে ছাড়ে না এবং বলে সে আসলে তাদের কেউ না। একবার সে তার চাচার বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। আইসিসের দ্বারা মগজধোলাই হওয়া শিশুটির মাঝে জন্ম নিয়েছে পাশবিক নির্দয় হিংস্র মন আর নিজেকে ভাবতে শিখেছে সিংহের মত সাহসী। আসলে শিশুটি নিজের মানসিক দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত, তার নিজের কাছে মনে হতে থাকে পরিবারের সবার মধ্যে সে একাকী, ফলে সামান্য উস্কানিতেও সে অতিমাত্রায় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।
ইরাক এবং সিরিয়াতে শেষ ঘাঁটিতে হেরে যাওয়া আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে কী বলা যেতে পারে? প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের ঘোষণা এখন মনে হচ্ছে বেশ অপরিপক্ব। যুদ্ধের ময়দানের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের মনে প্রাণে যুদ্ধের দামামা এখনো বিরাজমান।
যেসব দেশের মাঝে যুদ্ধ হয়েছে এবং যেসব দেশ হেরে গেছে তারা এখনো নিজেদের সীমান্তে প্রতিরোধ, পালটা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই ১৯৯০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত যদিও এইসব সন্ত্রাসী জঙ্গি-গ্রুপের নির্দিষ্ট কোন দেশের গণ্ডী নেই, নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ঠিকানায় সীমাবদ্ধ নেই। আইসিস যে অঞ্চলকে নিজেদের রাষ্ট্র দাবী করে এবং সেই কাল্পনিক রাষ্ট্রের নাম ভাঙিয়ে জঙ্গিদের দলে ভিড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা বেশ কঠিন কাজ। কারণ এটা এখন বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের মত ছড়িয়ে পড়েছে। কীভাবে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিদের মোকাবেলা করা যাবে এটাই এখনকার সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তারক্ষীদের প্রধান আলোচ্য প্রশ্ন। কীসের মায়া জাদুবলে আইসিস তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে ইরাক এবং সিরিয়ার ৮০ লাখ নাগরিকদের শাসন করেছে এবং কীসের আকর্ষণে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রায় ৪০,০০০ বিদেশী জঙ্গি যোদ্ধা আইসিস খেলাফতের হয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিল? কী কারণে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মুসলিম ইসলামের এই চরমপন্থাকে সমর্থন করছে? এবং ইরাকের উত্তরাঞ্চলের যেসব হাজার হাজার শিশু আইসিসের পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল তাদের ভাগ্যে কী আছে? আইসিস ইয়াজিদি শিশুদেরকে তাদের পরিবার থেকে আলাদা করেছে, কখনোবা এইসব শিশুদের চোখের সামনে তাদের বাবামাকে হত্যা করেছে। এরকম মানসিক যন্ত্রণার দুর্বল মুহূর্তে আইসিস তাদের মনে গেঁথে দিয়েছে সন্ত্রাসবাদের বীজ। চোখের সামনে বাবামা’কে সদ্য খুন হতে দেখা শিশুদেরকে বলা হয় তোমরাই আইসিসের ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনী। তাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয় বিজয়ীদের বর্বরতা। আইসিস এইসব শিশুদের খাবারে মিশিয়ে দেয় মানসিক বিকলাঙ্গতা সৃষ্টিকারী ভয়াবহ মাদক কেপ্টাগন এমফিটামিন ফলে তাদের আর কোন ভয়ের অনুভূতি থাকে না। এই অবস্থায় তাদেরকে আত্মঘাতী বোমা হামলার জন্য ট্রেনিং দেয় আইসিস। দুর্ধর্ষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ময়দানে তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয় সামনের কাতারে, বাধ্য করা হয় সবসময় আত্মঘাতী বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি বেল্ট পরে থাকতে। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া আছে যদি শত্রুপক্ষ খুব কাছাকাছি চলে আসে তাহলে যাতে আত্মঘাতী বোমার আঘাতে শত্রুকে উড়িয়ে দিতে পারে।
![]() |
A photograph of Kamiran, as an ISIS fighter, among family pictures at his home. |
এই শিশুরা বেড়ে উঠছে হাজার হাজার স্বাভাবিক মানুষের সাক্ষাৎ যমদূতের হুমকি নিয়ে কিন্তু তাদেরকে সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাও অবশ্য কর্তব্য। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যানুসারে ইরাকে ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে ১৫০০ সুন্নি মুসলিম শিশুকে আটক করা হয়েছে। আইসিসের সদস্য হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। শত শত আইসিসের শিশু যোদ্ধা যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে পরিবারের সাথে বসবাস শুরু করেছে। তাদের মনে এবং শরীরে যুদ্ধের ক্ষত বিরাজমান।
এখন ইয়াজিদি বালকের অবস্থান হয়ে গেছে অপরাধ বোধ আর নিজেকে ভুলে যাওয়ার মাঝামাঝি চিন্তাশূন্য ফাঁকা মগজ। তাদের মত আর কেউ আইসিসের নির্মম বর্বরতার শিকার হয়নি। তাদের চোখের সামনে গুলি করে, শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়েছে তাদের মা-বাবা, ভাইবোনসহ পরিবারের সবাইকে, আবার তাদেরকেই যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে শিশু সৈনিক হিসেবে।
নাইনভে সমতলভূমি মশুল শহরের উত্তর থেকে পূর্বদিক পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে শত বছর ধরে অ্যাসিরিয়ান, ক্যালডিয়ান, সিরিয়াক ইত্যাদি প্রাচীন বিশ্বাসের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিরাজিত ছিল। তবুও এখানেই প্রায় পাঁচ লাখ ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী নিয়মিত খুন জখমের শিকার হতে থাকে। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ বলেন-২০১৪ সালে আইসিস পুরো এলাকার ক্ষমতা দখল করে নেয়ার পরে ইরাকে তাদের অবস্থা ১৯৭২ সালের বুরুন্ডির টাট্সি আর হুটু সম্প্রদায়ের জাতিগত কোন্দলের জেরে সংঘটিত গণহত্যার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ইয়াজিদি সম্প্রদায়কে হত্যা, বন্দী এবং দাসে পরিণত করে আইসিস ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যাকে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে ফেলেছে। কুর্দি সরকারের অপহরণ সম্পর্কিত সরকারী দফতরের পরিচালক হুসেইন আল-কায়েদির হিসাব মতে প্রায় ৬০০০ ইয়াজিদি এখনো নিখোঁজ রয়ে গেছে। আইসিস তাদের শেষ শক্ত ঘাঁটি থেকে উৎখাতের সময় প্রায় ৩০০০ ইয়াজিদিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
কোনক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ইয়াজিদিরা বলেছিল কীভাবে তাদের আরব প্রতিবেশীরা আইসিসে যোগ দিয়েছিল তাদের বাড়িঘর, জমিজমা, সম্পত্তি, নারী দখল করার জন্য, কীভাবে তাদের পরিবার ও প্রিয়জনকে হত্যা করেছে আর নিজ ভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। শত শত, হাজার হাজার ইয়াজিদি এখন শরণার্থী শিবিরে ছোট খুপড়ি ঘরে, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মানবেতর জীবন যাপন করছে। কেউ হয়ত আশ্রয় নিয়েছে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে। কারো আশ্রয় হয়েছে কুর্দিশ শহরের প্রান্তে বা গ্রামের দিকে নির্মাণাধীন বাড়িঘরে। ইয়াজিদিরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে ভবিষ্যতে তাদের উপর গণহত্যার খড়গ নেমে এলে ইরাকি সরকার তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে এটা তারা বিশ্বাস করে না। কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া বা অন্য যেকোনো অমুসলিম দেশ যদি ইয়াজিদিদেরকে দেয় আশ্রয় তবে তারা সেখানে চলে যাবে।
এভাবে দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলে তাদের সম্প্রদায়ের টিকে থাকে দুরূহ হয়ে পড়বে। পূর্বে ইয়াজিদি ধর্মবিশ্বাস ছিল বংশ পরম্পরায় জন্মসূত্রে প্রাপ্ত, পিতৃতান্ত্রিক রক্তের ধারায় বহমান এবং সম্প্রদায়টি তিনটি গোত্রে বিভাজিত এবং তাদের মধ্যে আন্তঃ-বিবাহ নিষিদ্ধ। ক্রমাগত সংকুচিত হতে হতে এই ধর্মীয় বিশ্বাসটির অস্তিত্ব এখন আরও হুমকির মুখে। ইয়াজিদি সম্প্রদায় আরও সংকটে পড়ছে অপহৃত শিশুদের নিয়ে। আইসিসের কবল মুক্ত হয়ে ফিরে আসার পরে তাদেরকে সুস্থ করে তুলতে হবে এবং ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে যেটা সত্যিই দুরূহ কাজ।
![]() |
Boys and young men have little to do and lots of time to think at the camps around Duhok, where some of the roughly 250,000 Yezidis have been displaced from their homes, afraid to go back. |
টাইম ম্যাগাজিন আইসিসের মৃত্যু কূপ থেকে বেঁচে আসা কয়েকজনের সাথে সাক্ষাৎ করেছে। আইসিসের কবলে থাকা অবস্থায় তারা কেমন ছিল সে বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছে কিছু অপেক্ষাকৃত বয়স্ক বালকদের সাথে। যারা ১৮ বছরের নিচে তাদের সাথে বলেছে তাদের বাবা-মা অথবা বর্তমান অভিভাবকদের উপস্থিতিতে।
প্রতিটি বালকের করুণ-কাহিনী শুরু হয়েছে একই প্রক্রিয়ায়। তারা জানায় আইসিস যখন তাদের গ্রামে আক্রমণ করে সেই সময়ের কথা, আইসিস তাদের বাবা, বড়ভাই বা চাচাদের বন্দী করে নিয়ে যায়। কখনো কখনো তাদেরকে তাদের মা, বড়বোনদের সাথে কিছুক্ষণ অবস্থান করার সাময়িক অনুমতি দেয় কিন্তু এমন সুযোগ বা সৌভাগ্য সবার ক্ষেত্রে জোটে না, কারণ অনেক সময় তাদেরকে স্কুলের ক্লাসরুম থেকে, বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে, বাড়ি থেকে গবাদিপশুর মত টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আলাদা করে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে ভিড়িয়ে দিতো। ছোটবেলার সেই অপরিপক্ব মগজে রোপণ করে দেয়া হল ইসলামের উগ্র ধর্মীয় শিক্ষা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ এবং ১৩ বছরের হতভাগ্য বালককে পাঠিয়ে দেয়া হল যুদ্ধের ময়দানে।
থিককরান কামিরান নামের একজন ১৯ বছরের ছেলে টাইম ম্যাগাজিনের কাছে বর্ণনা করছে আইসিস তাদের গ্রামে প্রবেশকালীন দৃশ্য এবং জঙ্গি-দলটি কৌশলে গ্রামের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের নেতাকে বোঝায় তিনি যেন গ্রামের সব ইয়াজিদিকে স্কুলের মাঠে জড়ো হতে বলেন। তাদেরকে বলা হয় কেউ যদি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে না চায় তারাও নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে।
আইসিস স্কুলের মাঠে সমবেত ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের সকল পুরুষ এবং কিশোরদেরকে তিনটে ট্রাকে বোঝাই করে তাদের নিরাপত্তার কথা বলে কাছে ধারের সিনাই পর্বতে নিয়ে যায়। তখন থিকরানের বয়স ছিল মাত্র ১৫, সে রয়ে যায় তার মা এবং বোনের সাথে। সেদিন থিকরান ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল স্কুল মাঠে। কিছুক্ষণ পরেই তারা শুনতে পেল নিকট দূর থেকে ভেসে আসছে মুহুর্মুহু বজ্রপাতের মত গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গি জীপ। আতংকে সিটিয়ে থাকা জড়োসড়ো নারী ও শিশুদেরকে আইসিস জঙ্গিরা সান্ত্বনা দিয়ে বলে এগুলো কিছুই নয়, হয়ত কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ারকে লক্ষ্য করে গুলি করা হচ্ছে। কিন্তু স্কুল মাঠের সমস্ত নারী ও ছোট ছোট শিশুরা পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিল সেই মুহূর্তে তাদের বাবা, স্বামী, ভাই, সন্তানদেরকে গুলি করার শব্দ।
আইসিস ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের নেতা থিকারানের দাদুকে সবাইকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখে। তাকে সেই গুলির আতংকিত শব্দ শুনতে বাধ্য করা হয়। তখন তিনি বুঝতে পারেন, তিনি নিজেই তার সম্প্রদায়ের লোকদের কী মরণঘাতী ফাঁদে পা দিতে উৎসাহিত করেছিলেন। সবার শেষে তাকেও হত্যা করে আইসিস।
![]() |
Khayri Abdullah Massi ransomed family members, but his wife went back to raise the child she had by her “ISIS husband.” |
সেদিনই থিকরান শিখে যায় কীভাবে রাগ এবং ভয় লুকিয়ে রাখতে হয়। থিকরানকে তার মা এবং বোনের সাথে বন্দী করে আইসিস নিয়ে যায় তাদের শক্ত ঘাঁটি তেল আফারে। সেখান থেকে থিকরানকে পাঠানো হয় আইসিস পরিচালিত ইসলামের সালাফি মাদ্রাসায় সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে তার কুরআন শিক্ষা। থিকরান জানায় সালাফি মাদ্রাসায় সে কুরআন মুখস্থ শিখে যায় এবং তার সাথের অন্যান্য বন্দী শিশুদের থেকে অধিক দ্রুত আইসিসের মতাদর্শ আয়ত্ত্ব করে ফেলে। ফলে আইসিসের মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাকে মাদ্রাসার কুরআন শিক্ষক বানিয়ে দেয়। যদিও থিকরান জানত এই পদোন্নতি আসলে তার কতটা অধঃপতন। থিকরান টাইম ম্যাগাজিনের সাথে আলাপ কালে জানায় এই যোগ্যতার কারণে তাকে সরাসরি যুদ্ধ করতে হয়নি।
আমরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলাম এবং আইসিসকে বললাম, “আমরা তোমাদেরকে মেনে চলবো।” থিকরান জানায়, নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচাতে আমি ধর্মকে বলিদান করেছি। এর জন্য আমার কোন অনুশোচনা নেই। ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের অনেক বালকদের বারংবার প্রশ্নের জবাবে আমি উত্তর দিই না, আমি এখন আর কিছুই অনুভব করি না। রাগ, ক্ষোভ, দুখ ব্যথা, ভয়কে কবর দিয়ে বেঁচে থাকা শিখতে হয়, এটা একটা যোগ্যতা। আবেগকে জাগিয়ে তোলার মানে হল যে প্রিজন খুন হয়ে গেছে তার কথা ভেবে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে যাওয়া। আইসিস যাদেরকে মেরে ফেলেছে তাদের জন্য যারা বেঁচে আছে তারা নিজেদের দোষী মনে করে। যাইহোক তাদেরকে তো বেঁচে থাকতে হবে। তাই তারা মানব বোমা হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে ইয়াজিদি শিশু সৈনিকদেরকে অন্য সৈন্যদের সাথে দল বেঁধে রাখত। আইসিসের প্রশিক্ষক ইয়াজিদি গোত্রের শিশুদের মাঝে আন্তঃসম্পর্ক ধ্বংস করতে চায়। এই উপলক্ষে ইয়াজিদি কোন শিশুর উপর সেই দলের দায়িত্ব অর্পণ করত। যদি কেউ দ্রুত কোন অস্ত্রের নাম মনে করতে না পারে তাহলে তাদেরকে নির্দয়-ভাবে পেটানো হতো।
১৬ বছরের দুই চাচাতো ভাই টাইম ম্যাগাজিনকে জানায়, আইসিস কীভাবে ইয়াজিদি ইউনিটে প্রশিক্ষণ দিতো। তাদেরকে যুদ্ধের প্রথম সারিতে মোতায়েন করত। এই দলের নাম ছিল “লাইন অফ প্যারাডাইজ”। আইসিস সিরিয়ান আর্মির সাথে যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের সেনাদের গোলার মুখে, বিমান হামলা থেকে রক্ষা পেতে এবং কামানের গোলার মুখে ছেড়ে দিতো ইয়াজিদি শিশু সৈন্যদের। চাচাতো ভাই দুজন জানায়, তাদেরকে বেশীরভাগ সময় আত্মঘাতী বোমা হামলার বেল্ট পরে থাকতে বাধ্য করা করত। আত্মঘাতী বোমা হামলার বেল্টের মধ্যে ধাতব কুচি দেয়া থাকে যাতে আক্রমণকারী শত্রুপক্ষ ইয়াজিদি সৈন্যদের মোকাবেলা করা সময় নিহত হয়।
অনেক ইয়াজিদি শিশুকে মানুষ হত্যা করার খুঁটিনাটি প্রশিক্ষণ দেয়া হত। যেমন ক্যাম্পে শিশু সৈন্যদেরকে জবাই করার কৌশল, কীভাবে বন্দীদের চুলের মুঠি ধরে মাথা তুলে ধরে গলা কাটতে হয়, মানুষ জবাই করার দৃশ্য দেখাও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের অংশ। আইসিসের কবল থেকে ফিরে আসা ইয়াজিদি শিশুরা বর্ণনা করছে তারা শিখেছিল কেউ চুরি করে ধরা পড়লে শাস্তিস্বরূপ কীভাবে তার হাত পা কাটতে হয়। একজন বলেছিল, প্রক্রিয়াটা এমন যেন হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে চেতনাহীন রোগীর শরীর থেকে তার অঙ্গ আলাদা করে ফেলা। কী ভয়ানক নির্বিকার!
কিছু ইয়াজিদি শিশুকে শেখানো হয় কেউ যদি আইসিসের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে এবং দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে কীভাবে তার হাতে পায়ে পেরেক ঠুকে দিতে হয়। প্রায় প্রতি সপ্তাহে অপরাধী ধরা পড়ত এবং তাদের শাস্তি দেয়া হত এভাবেই। মৃতদেরকে প্রকাশ্যে জনসমাগম বেশী হয় এমন স্থানে, ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে পচে গলে যাওয়া পর্যন্ত কয়েকদিন ঝুলিয়ে রাখা হত যাতে পথচারী মানুষ মৃতদের কৃতকর্মের ফল দেখতে পায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধী মৃত ব্যক্তির অপরাধ ছিল আইসিস সংস্করণের ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি।
এত দুঃস্বপ্নের মত নৃশংসতার মধ্যে ইয়াজিদি শিশুদেরকে বিলাসী অনন্ত বেহেশতের লোভ দিতো আইসিস। তাদেরকে যারা বন্দী করেছিল, সেই আইসিস তাদেরকে বলে তোমাদের পরিবারের সবাই তো দোজখে যাবে কিন্তু তোমরা সঠিক পথে আছো, তোমরা যারা খেলাফতের অধীনে এসেছ, তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে অফুরন্ত সুখের বেহেশত। আইসিসের বর্বরতা থেকে পালিয়ে আসা শালালের বয়স এখন ১৫ এবং কণ্ঠ এখনো কিছুটা উচ্চকিত এবং তাতে শৈশবের ছাপ স্পষ্ট। যখন আইসিস তার মা, বড়বোন এবং ভাইয়ের সাথে তাকেও বন্দী করে নিয়ে তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১১। সেই নিতান্ত শিশু বয়সেই শালালকে আইসিসের বন্দীশিবিরে উগ্র ধর্মীয় শিক্ষা এবং জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেয়। শালাল টাইম ম্যাগাজিনের সাথে আলাপচারিতায় জানায়, উগ্র ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাবে তাদের মনস্তত্ত্ব ভয়ানকভাবে চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে যখন পুনরায় পরিবারের সাথে মিলিত হলাম তখন পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলার সময় আইসিসের শেখানো ভাষায় তাদের সাথে কথা বলতাম। তাদেরকে মুসলিম হওয়ার জন্য চাপ দিতাম।
আইসিসকে লক্ষ্য করে যখন যৌথবাহিনীর গোলা-বোমা বর্ষণ বেড়ে যায় তখন শালাল বুঝতে পারে তার মা, বোন এবং ভাইকে নিয়ে আইসিসের স্বঘোষিত খেলাফতের রাজধানী রাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার এটাই মোক্ষম সময় ও সুযোগ। সে কোনক্রমে ইরাকে তার বাবার সাথে ফোনে কথা বলতে সক্ষম হয়। শালালের বাবা একজন মানব পাচারকারীর সাথে যোগাযোগ করে শালাল এবং তার ৭ বছরের ছোটভাই হাকিমের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে। ৭ বছরের হাকিমও ছিল আইসিসের সম্মুখভাগের যোদ্ধা। শালাল এসব মনে করতেই কেমন যেন শিউরে ওঠে। স্মৃতি হাতড়ে শালাল বলতে থাকে, কীভাবে রাতের আঁধারে ঝোপঝাড় পেরিয়ে তার ভাইকে নিয়ে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছিল। শালালের মা এবং বোনকে পরে আইসিসের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল এবং তার জন্য দালালকে দিতে হয়েছিল মাথাপিছু ১০,০০০ মার্কিন ডলার।
আইসিসের বন্দিত্ব থেকে শালালের পরিবারের পালিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল আইসিসের কারণে যুদ্ধকবলিত ইরাক এবং সিরিয়া অঞ্চলের অদ্ভুত অর্থনীতি। আইসিসের পতনের সময়ে আইসিসের কিছু নেতা মার্চের দিকে সিরিয়া এবং ইরাক থেকে বন্দী করা মানুষদেরকে হস্তান্তরের বিনিময়ে তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিশাল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ফন্দি আঁটে। উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তান সরকার অপহৃত শিশুদেরকে আইসিসের কবল থেকে মুক্ত করে পরিবারের কাছে ফেরত দেয়ার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলারের একটা তহবিল গঠন করে। অনেকের মত শালালের বাবাও স্ত্রী, সন্তানদের মুক্ত করতে আইসিসকে মুক্তিপণ দিয়েছিল। এখন কুর্দিস্তান সরকারের কাছে আবেদন করেছে যদি তহবিল থেকে কিছু অর্থ সাহায্য পাওয়া যায় সেই আশায়।
আইসিসের বন্দিত্ব থেকে শালালের পরিবারের পালিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল আইসিসের কারণে যুদ্ধকবলিত ইরাক এবং সিরিয়া অঞ্চলের অদ্ভুত অর্থনীতি। আইসিসের পতনের সময়ে আইসিসের কিছু নেতা মার্চের দিকে সিরিয়া এবং ইরাক থেকে বন্দী করা মানুষদেরকে হস্তান্তরের বিনিময়ে তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিশাল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ফন্দি আঁটে। উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তান সরকার অপহৃত শিশুদেরকে আইসিসের কবল থেকে মুক্ত করে পরিবারের কাছে ফেরত দেয়ার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলারের একটা তহবিল গঠন করে। অনেকের মত শালালের বাবাও স্ত্রী, সন্তানদের মুক্ত করতে আইসিসকে মুক্তিপণ দিয়েছিল। এখন কুর্দিস্তান সরকারের কাছে আবেদন করেছে যদি তহবিল থেকে কিছু অর্থ সাহায্য পাওয়া যায় সেই আশায়।
ইয়াজিদি বালকদের মুক্ত হয়ে তাদের নিজ পরিবারে ফেরা নতুন যাত্রার সূচনা মাত্র। শালালের বাবা এই প্রতিবেদককে জানান, শালাল যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন প্রথম দিকে দারুণ উগ্র ছিল আর রাগান্বিত থাকত সবসময়। শালালের বাবা নিজেও একবার ব্যবসায়ের কাজে ভ্রমণরত অবস্থায় আইসিসের হাতে বন্দী হওয়া থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায়। শালাল এখন একটু শান্ত এবং কিছুটা বিমর্ষ। সে তার বাবার পাশে বসে আছে এবং আইসিসের সাথে কাটানো দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে করছে। তাকিয়ে আছে তাদের নির্মাণাধীন বাড়ির মেঝের দিকে এবং তার স্মার্ট ফোন নিয়ে এটা সেটা করে সময় পার করছে। আইসিসের যোদ্ধা হিসেবে সে কী দেখেছিল আর কী কী কাজে অংশ নিয়েছিল সে সম্পর্কিত বিস্তারিত কথা বলতে রাজি নয়। তার বাবা যিনি ছাত্রাবস্থায় মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি নিজেই এখন সন্তানের শিক্ষকের ভূমিকায়। তিনি জোরালোভাবে দাবী করলেন তার সন্তান পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে এবং তার কাউন্সেলিংয়ের দরকার নেই। কিন্তু শালালের চাচাতো ভাই আশরাভে যখন আইসিসের হয়ে যুদ্ধের কথা বলছিল তখন শালালকে দেখা যাচ্ছে দূর দিগন্তে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যা টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদককে অন্যকিছুর ইঙ্গিত দেয়।
আশরাভে সিরিয়ার কোন একটা তল্লাশি কেন্দ্রে ভয়ানক যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। যুদ্ধে আশরাভের গায়ে মর্টারের গুলির আঘাতে মারাত্মকভাবে জখম হয়। আশরাভের ইউনিটের দুইটা ছেলে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। তার পায়ে এখনো গুলির চিহ্ন রয়ে গেছে এবং সেটা মাঝেমধ্যেই ব্যথার জানান দেয়। আশরাফে বাড়ি ফেরার পথে একটা ইয়াজিদি বউ নিয়ে এসেছে যাকে আইসিস’রা তাকে দান করেছিল। কোন রকম চাকরি নেই, টাকা ইনকামের উৎসের কোন ঠিকঠিকানা নাই তবুও মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তার স্ত্রীর ভরণ পোষণ নির্বাহ করতে গিয়ে আশরাভে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তাকে দেখভাল করতে গিয়ে তার প্রাণের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে সুতরাং তাকে তাদের সাংসারিক খরচ, খাবারদাবার এবং বসবাসের জন্য যে অর্ধনির্মিত এপার্টমেন্টের নির্মাণ কাজ চলছে তার জন্য মনোবিজ্ঞানী চাচার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। নির্মাণাধীন এপার্টমেন্টের খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে ফেব্রুয়ারির শীতের বাতাস আসে।
ইয়াজিদি পরিবারগুলোতে যুদ্ধের আরও আরও বর্ণনাতীত দুর্দশা ডেকে এনেছে। আইসিসের কাছে বন্দী থাকা অবস্থায় শালালের মা এক আইসিস জঙ্গির সন্তান ধারণ করে ফেলে। শালালের বাবা এই সন্তানের দায় কেন নেবে? সে এই সন্তান নিতে রাজি নয়। সুতরাং আইসিসের বন্দিত্ব থেকে ছেলেমেয়েসহ মুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে শালালের মা সেই সন্তানকে মশুলের কাছে একটা এতিমখানায় রেখে এসেছে যেখানে এরকম অনেক আইসিস সন্তানদেরকে পাঠানো হয়েছে। চিরতরে ত্যাগ করা ছেলের জন্য মাঝেমাঝে তার মন কাঁদে, তখন তার স্বামী জানায় সে স্বামী পরিবার ছেড়ে সেই সন্তানের কাছে চলে যেতে পারে।
দীর্ঘদিনের পারিবারিক যন্ত্রণার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে ইরাকের সংবিধানের উপর। আইসিস জঙ্গির ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তান অথবা পিতৃপরিচয়হীন শিশুদেরকে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম হিসেবে নিবন্ধন করা হয়েছে। খুব সঙ্গত কারণেই নিবন্ধিত শিশুর মায়ের ধর্মীয় পরিচয় লিখিত হয়েছে ইসলামের নামে। ইয়াজিদি সচেতন এবং বয়স্ক মানুষেরা এই ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তনকে সাংবিধানিক গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন এবং বাগদাদে ইরাকি সরকারী কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন করেছেন অবিলম্বে তাদের ধর্মীয় পরিচয় ফিরিয়ে দেয়ার জন্য।
ইয়াজিদি ধর্মীয় নেতা বাবা শেখের পুত্র ইয়াজিদি প্রতিশ্রুতিশীল নেতা হাদি বাবাশেখি দাবী করেন তার সম্প্রদায় শালালের সৎ ভাইদেরকে স্থান দিতে রাজি আছে। কিন্তু অন্যান্য ইয়াজিদি নেতা, আইসিসের হাতে বন্দী ইয়াজিদি দাসের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তান গ্রহণ প্রসঙ্গে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই হাদি বাবাশেখির উদার দাবীকে নাকচ করে দিয়ে বলছেন ইয়াজিদি সম্প্রদায় এই ধরণের সন্তানের দায় নেবে না। সুতরাং শালালের মায়ের মত অমীমাংসিত, নামগোত্রহীন অ-নিবন্ধিত আইসিস দাস বাধ্য হচ্ছে তার পরিবার এবং বিশ্বাসকে বেছে নিতে অথবা আইসিসের কাছে বন্দী অবস্থায় যে সন্তান ধারণ করেছিলেন তার কাছে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে চলে যেতে।
শালালের বাবা রাগান্বিত এবং কিছুটা বিরক্ত। তার স্ত্রী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে মাঝেমাঝেই এমন অভিযোগ করে। যখন সে তার নিজের সন্তান শালালের প্রসঙ্গ তোলে তখন শালালকে আর একবার আবেগের ভার বহন করতে হয়।
যুদ্ধের ময়দানে আইসিসের সাথে যুদ্ধে কখনো রশদের অভাব হয় নি। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির তথ্যানুসারে ২০১৯ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিকবাহিনী ইরাক-সিরিয়া অঞ্চলের যুদ্ধ খাতে ৫৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গল্পের মোড় ভিন্নদিকে ঘুরে গেছে, প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সুতরাং সামাজিক সেবাখাত, কাউন্সেলিংয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ পাওয়া প্রায় দুরূহ হয়ে পড়েছে।
ইয়াজিদি বালকেরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার জায়গা থেকে সাধ্যমত সাহায্য পাচ্ছে। ইয়াজিদি ধর্মগুরুরা ২০১৪ সালে এক অধ্যাদেশ জারি করে বলছে যেসব ইয়াজিদি আইসিসের অস্ত্রের মুখে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে অথবা ধর্ষণের শিকার হয়েছে অথবা মানুষ খুন করতে বাধ্য হয়েছে বা মানুষের অঙ্গহানি করতে বাধ্য হয়েছে তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হল। এই ঘোষণার পরে ধর্মীয় প্রথা চালু হল আইসিসের অস্ত্রের মুখে যেসব পুরুষ, নারী ও শিশু যেসব পাপ করেছিল তারা দীক্ষানুষ্ঠানের মাধ্যমে পাপ মোচনের সুযোগ পাবে।
ইয়াজিদি প্রতিশ্রুতিশীল নেতা হাদি বাবাশেখি বলেন, আমরা আস্তে ধীরে পর্যায়ক্রমে ইয়াজিদি নারীদের গর্ভে জন্ম নেয়া শিশুদেরকে মানবিক কারণে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের হ্রদয়ে আত্তীকরণ করে নেবো কারণ ইয়াজিদির মত শান্তিপূর্ণ ধর্ম আর নেই। দীক্ষানুষ্ঠান হবে ইয়াজিদি ধর্মের পবিত্র স্থান লালিশে। লালিশ জায়গাটা হল ইরাকের কুর্দিস্তানের চারিদিকে পাহাড়ঘেরা অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ডুহোক উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে। প্রতিটি ইয়াজিদি ধর্মানুসারীকে তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার লালিশে গিয়ে সেখানের ৪-৫ ফুট গভীর একটা ছোট্ট কুয়ার মধ্যে ডুব দিয়ে আসতে হয়। কুয়ার পাশেই আছে পাথরের মন্দির যেটা ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত পবিত্র।
প্রাপ্ত বয়স্ক ইয়াজিদিরা বলছেন, দীক্ষানুষ্ঠান হয়ত কিছুটা সাহায্য করতে পারে, কিন্তু অন্যরা বলছে ভিন্ন কথা। দীক্ষানুষ্ঠান শিশুদের মনোজগতে ভাইরাসের মত সংক্রমিত দুঃস্বপ্ন যা তাদেরকে বারবার অতীতে টেনে নিয়ে যায়, শিশুদের মনে অপরাধ বোধের জন্ম দেয় এবং যার ফলে শিশুরা অসহনীয় অন্তর্গত হতাশায় ডুবে যায় বা অনেক ক্ষেত্রে বহিরঙ্গে রাগান্বিত হয়ে পড়ে তার থেকে মুক্তি কীসে? ডুহোক হতে পারে ইরাকের শিশু কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের একমাত্র কেন্দ্র। কিন্তু কাউন্সিলর তখন ব্যাখ্যা দিলেন তাদের কাছে এই উদ্যোগের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্ধ নাই, শিশু কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার জন্য নিয়মিত এবং প্রয়োজনীয় জনবলই বা কোথায় পাবেন। যে পরিবেশে শিশুরা মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধা করত না সেই পরিবেশ পরিস্থিতি তাদের মন থেকে দূরীভূত করা এত সহজ নয়। এর জন্য দরকার সমন্বিত মানসিক এবং আর্থ-সামাজিক পদক্ষেপ।
ডুহোক অঞ্চলের একমাত্র শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ গালাভেজ জাফর বলেন, “ইয়াজিদি শিশুদের সাথে যা ঘটেছে সেটাকে শুধু মগজধোলাই বললে ঘটনার ব্যাপকতাকে ছোট করে উপস্থাপন করা হবে।” কুর্দিস্তানের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান SEED’এর একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরাজ আদিল বলেন, “যখন ইয়াজিদি শিশুরা আইসিসের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মধ্যে ফিরে এলো তখন তারা ছিল সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, সবাই তাদের প্রতি বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা দেখিয়েছিল কিন্তু কিছুদিন পরেই শিশুদের প্রতি ইয়াজিদিদের সেই আগ্রহ কর্পুরের মত উবে গেছে, যখন তাদের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে তখনই তাদের মানসিক বৈকল্যের লক্ষণ প্রকাশ পেতে লাগল এবং আপনারা দেখতে লাগলেন শিশুদের মানসিক যন্ত্রণার পরবর্তী বিরূপ আচরণ, হতাশা এবং উদ্বিগ্নতা। একই সাথে এইসব শিশুদের মাঝে দেখা দিতে লাগল আইসিসে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা।”
মানসিকভাবে আঘাত পাওয়া এইসব শিশুদেরকে সুস্থতার জন্য অনেক সুবিশাল কর্মপরিকল্পনা দরকার সেটা শুধু ব্যক্তি বিশেষ থেকে নয় বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের নিরাপত্তা ও মানবিক সংস্থাগুলো থেকেও। যদিও ইয়াজিদি শিশুদের বিষয়টা এখনো অগোছালো এবং সেখানে কিছু সাংর্ঘষিক বিষয় আছে। ইয়াজিদি বয়স্করা শিশুদের ঝুঁকিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। যদিও বাগদাদ ঠিক একই সময়ে আন্তর্জাতিক বিধি মোতাবেক শিশু সৈন্যদেরকে পুনর্বাসন করছে কিন্তু ইয়াজিদি শিশুদেরকে সযত্নে এড়িয়ে গেছে, এমনকি ১৩ বছরের সুন্নি শিশুদেরকেও জেলে পুরে দিয়েছে। সেখানেও অনিশ্চয়তা কত সংখ্যক শিশু নিয়ে তারা কাজ করবে। আইসিস মোটের উপর ৬৪০০ জন ইয়াজিদিকে ধরে নিয়ে গেছিল যাদের মধ্যে ১৮৫৫ জন শিশুকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে ৩০০ জন শিশু আইসিসের পক্ষে যুদ্ধ করেছে বলে নিজেদের নাম লেখাতে পেরেছে। কিন্তু কুর্দিশ সরকারের অপহরণ বিভাগ মনে করছে আইসিসের পক্ষে যুদ্ধ করা ইয়াজিদি শিশুদের পরিমাণ প্রকাশিত সংখ্যার থেকেও অনেক বেশী।
মনে করা হচ্ছে ১৩ থেকে ১৭ বছরের কমপক্ষে ১২০০ ইয়াজিদি শিশুকে আইসিস জঙ্গিরা অপহরণ করে নিয়ে যায় তাদের সামরিক ঘাটিতে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে। কুর্দিশ সরকারের অপহরণ বিভাগের প্রধান বলেন, আইসিস থেকে ফিরে আসা শতাধিক শিশুর সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি। যেসব শিশুর এখনো আইসিসের হাতে বন্দী আছে এবং জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তারা সারা বিশ্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। এইসব শিশুরা আদর্শিকভাবে এবং বাস্তবিকভাবে আত্মঘাতী হামলার জন্য প্রস্তুত। তাদেরকে জীবন্ত মানব বোমা বানানো হয়ে গেছে, এখন শুধু আইসিসের ট্রিগার টিপতে বাকি, ওমনি তারা দিকে দিকে ছড়িয়ে গিয়ে সশব্দে বিস্ফোরিত হবে।
অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ইয়াহাদ-ইন উনুম’ এর প্রতিষ্ঠাতা ক্যাথলিক ধর্মগুরু ফাদার প্যাট্রিক ডেসবইস আইসিসের মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে ফেরা শতাধিক ইয়াজিদির সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করেছেন। তার প্রাথমিক আলোকপাত ছিল যুদ্ধ ফেরত ইয়াজিদি শিশুদের উপর এবং কেমন প্রশিক্ষণ শিশুদেরকে বিশ্বাস করতে শেখায় যে কোন স্থান বিশেষের খেলাফতের পতন ঘটলেও বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠার জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। ফ্রান্সের এই ধর্মগুরুর নিয়োগকৃত ইয়াজিদি স্বেচ্ছাসেবক দল নতুন আসা ইয়াজিদি শিশুদেরকে সর্বদা চোখে চোখে রাখতো। সাক্ষাৎকারের জন্য ডেসবইস নিজে একজন ক্যামেরাম্যান, ফটোগ্রাফার, দোভাষী এবং বেলজিয়ামের পুলিশের একজন সাবেক তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রস্তুত করে তার নিজের তাবুতে প্রশ্ন শুরু করতেন। ডেসবইস হয়ত প্রশ্ন করলেন, “তোমাকে যে সুইসাইড বেল্ট সবসময় পরে থাকতে হতো ওটা কি অনেক ভারী ছিল?”
ডেসবইস বলেন, তিনি কয়েকটা একাউন্টের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলতেন যেসব বাচ্চাদেরকে তোমরা সাদরে সম্বর্ধনা দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছ তারা ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে যদি তাদেরকে সতর্কভাবে সুস্থ স্বাভাবিক না করা হয়। ডেসবইস একজন বালকের গল্প বললেন যে এখন পশ্চিমে পুনর্বাসিত হয়েছে। সে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখে, আইসিস আবার জেগে উঠবে এই শ্লোগান বলতে বাধ্য করে আইসিস জঙ্গি-দল আমার মাকে হত্যা করেছে।
ডেসবইসের বানানো কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে আইসিসের কবল থেকে পালিয়ে আসা বালকদেরকে পুনর্বাসন করা সম্ভব। ডেসবইস আইসিস থেকে ফিরে আসা অন্যান্য বন্দীদের অভিজ্ঞতা জানালেন। ডুহোকের কাছেই নির্মিত ক্যাম্পে স্থান সংকুলান হল আইসিস থেকে পালিয়ে আসা শিশু সৈন্যদের কিন্তু এই শিশুরা শুরু করে দিল অন্য খেলা। তারা দলবেঁধে বানিয়ে ফেলল কয়েকটা উন্নতমানের আত্মঘাতী বিস্ফোরক বোমা। বোমাকে শেষ পর্যন্ত চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল এবং আত্মঘাতী বোমা হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করা যায় কোনক্রমে। ইয়াজিদি সম্প্রদায় এবং ডেসবইসের ইয়াহাদ-ইন উনুম প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্থতায় সে যাত্রায় তাদেরকে জেলে আটকে পড়া থেকে রক্ষা করে। ডেসবইস বলেন, “বহুদিনের প্রচেষ্টায় পারস্পরিক কাউন্সেলিং, খেলাধুলা এবং শিল্প সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে তাদেরকে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মূলস্রোতে প্রবাহিত করা সম্ভব হয়েছিল।”
কানাডা সরকারের অভিবাসন, উদ্বাস্তু এবং নাগরিকত্ব বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী মন্ত্রী ডেভিড মানিকোন বলেন, “উগ্রতা পরিহার করানোর কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদেরকে সমাজে পুনরায় একাত্ম করা সম্ভব।” তার দেশ আইসিসের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া ১৪০০ জন ইয়াজিদিকে গ্রহণ করেছে যাদের মধ্যে শিশু সৈন্যও আছে এবং তিনি তাদের সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু শিশুদের মানসিক ক্ষত এত গভীরে এবং এত প্রকট যে মনোরোগের চিকিৎসক বুঝতে পেরেছেন যে এই শিশুদেরকে একা একা কোথাও যেতে দেয়া যাবে না এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের সাথেও বেশি সময় বাইরে থাকতে দেয়া উচিৎ হবে না। কারণ এইসব শিশুদের মনোজগৎ এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে যে তারা সবসময় অতীত মানসিক বিকারের মধ্যে বাস করে।
এখন প্রশ্ন আসছে ন্যায় বিচারের কী হবে? ইতিমধ্যেই প্রশ্নটা অমীমাংসিত রয়ে গছে। ইরাকের উত্তরাঞ্চলের বিচারক আয়মান মোস্তফা কুর্দিশ হাইকমিশনের কাছে আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং ইয়াজিদিদের উপর গণহত্যা হয়েছে সেটা স্বীকার করে নেয়ার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু তার নিজের সেই ক্ষমতা নেই যে ক্ষমতাবলে আইসিসকে নিয়মমাফিক দোষী সাব্যস্ত করে বিচারের আওতায় আনতে পারেন এবং গণহত্যার অভিযোগ দায়ের করতে পারবে শুধু জাতিসংঘ। ইরাকি কর্তৃপক্ষও গণহত্যার মামলা করার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী নয় কারণ মনে হয় না এর জন্য আইসিস জঙ্গিদের কোন বড় ধরণের সাজা হবে। এরমধ্যে কী ঘটবে, হাজার হাজার আইসিস জঙ্গি সাধারণ নাগরিকের বেশে ইরাকে ফিরে তাদের অভ্যস্ত পূরণ জীবনে ফিরে যাবে, মশুল এবং তেল আফারে প্রকাশ্যে চলাচল শুরু করবে। ঠিক এই কারণেই শত শত হাজার হাজার ইয়াজিদি তাদের ঘরে ফিরে যায় নি কারণ তারা জানে তাদের জন্য আইসিস কী নিয়ে অপেক্ষা করছে। ইয়াজিদি শিশুরাও এটা ভালো করেই জানে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ইয়াজিদি শিশু বাড়ি ছেড়ে পালাতে চায়। মাসের পর মাস ধরে, সতর্ক মনোযোগ দিয়ে একদল থেরাপিস্ট সে এবং তার মাকে মানসিক চিকিৎসা দিচ্ছেন। কুর্দিশ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান SEED এর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আদিল বলেন, “প্রথমবার শিশুটি আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে গেছিল। দ্বিতীয়বার তার মা তাকে খুব মেরে ধরে আমাদের কাছে নিয়ে আসে।”
আদিল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিশুটিকে শেখানোর চেষ্টা করছে কোথা থেকে তার আবেগ সঞ্চারিত হচ্ছে, কীভাবে কোন গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রেনালাইন হরমোন নিঃসরিত হয়ে তার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে, আবেগের কোন স্তরে নাড়া দিচ্ছে এবং কীভাবে ক্রোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আদিল শিশুটিকে তার নিজের শরীর ও মনের নিয়ন্ত্রণ তাকে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন যেটা আইসিস তার কাছে ছিনিয়ে নিয়েছিল। একই সাথে তার মাকে শেখানো হচ্ছিল তিনি যেন তার সন্তানের উগ্র আচরণের জবাবে নিজেও উগ্র আচরণ করে তাকে মারাধরা না করেন। আদিল বললেন, ইরাকের বেশীরভাগ আদিবাসী পরিবার তাদের সন্তানদেরকে শাসন করার সময় শারীরিকভাবে আঘাত করেন। মা ও শিশু উভয়কেই শেখানো হল শারীরিক আঘাত ছাড়াই কীভাবে তাদের সন্তানরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।
এখন একজন মা বলছেন, তার বয়োঃসন্ধিক্ষণের সন্তান রেগে গেলেও তাকে মারতে ধাওয়া করে না। সেই মা তার সন্তানের ব্যাপারে বললেন, এখন তার সন্তান আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ছেলেটিও মায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মানসিক কাউন্সেলিংয়ের এখনো পূর্ণ সমাধান হয় নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিশুটি আইসিসের শেখানো অনেক এখনো মতাদর্শ মেনে চলে। সে একদিন থেরাপিস্টকে বলে, পুরুষ এবং বালকেরাই হল সমাজের সব, নারী ও মেয়েরা হল মূল্যহীন। কিন্তু থেরাপি নেয়ার পরে আইসিস থেকে ফেরার এক বছরের মধ্যে সেই শিশুটি তার মাকে বলছে, আমি বাড়ি ফিরতে পেরে অত্যন্ত সুখি কারণ পরিবারের দেখাশোনা করার জন্য সেই এখন একমাত্র জীবিত পুরুষ সদস্য।
No comments